রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুবাদে ৫ বছরে মোট পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করার সুযোগ হয়েছে। তার মধ্যে চতুর্থ বর্ষে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ শিরোনামে গবেষণা করতে গিয়ে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শিক্ষা উদ্যোক্তা হবো। এলাকার মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াবো । গ্রামের একটি অসহায় দুস্থ পরিবারের ছেলেকে হলেও মানুষের মতো মানুষ করবো। আজ শুধু একটি নয় বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করে নিজেকে ধন্য মনে করছি। হয়তোবা শিক্ষা উদ্যোক্তা হিসেবে এখনো খুব একটা সফলতার মুখ দেখতে পারিনি। কিন্তু প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আগামী পাঁচ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। লেখাটি সেদিনের সম্পাদকীয়ের জন্য জন্য লিখছিলাম। কিন্তু আমার প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষকের মন: কষ্টের জন্য লেখাটি আজকেই সম্পন্ন করতে হলো।
ছাত্র জীবন থেকেই টিউশনি ও কোচিং এ ক্লাস করিয়েছি।প্রত্যন্ত গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালিয়েছি দুই বছর। ওয়ার্ল্ডপ্লাস রেজিডেনশল স্কুল এন্ড কলেজে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে প্রায় ১২ বছর ধরে কর্মরত আছি। তাই শিক্ষকতা পেশাই দীর্ঘদিন থাকার ফলে কিছু অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। তাই আজ লিখছি যারা শিক্ষকতা পেশায় নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চান এবং নিজেকে সফল শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে চান তাকে কি কি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
আপনি যদি একজন শিক্ষক হয়ে থাকেন এবং শিক্ষকতা নিয়ে এগিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে থাকেন তবে আপনাকে অবশ্যই কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। কিছু অভ্যাস আয়ত্ত করার পাশাপাশি তা অনুশীলন করতে হবে নিয়মিত। আর তখনই আপনি উপভোগ করতে পারবেন ওই মহান পেশাকে।
আসুন, এক নজরে অভ্যাসগুলো জেনে নেই।
♦ শিক্ষকতাকে উপভোগ করা
আপনি তখনি পড়ানো'কে উপভোগ করতে পারবেন, যখন আপনি মন থেকে ক্লাসের বাচ্চাদের ভালোবাসবেন, তাদের উন্নতির কথা ভাববেন। আপনি নিজে পড়ানোকে মজার না বানাতে পারলে এটা প্রত্যাশা করতে পারেন না যে আপনার ক্লাসে বাচ্চারা তা মজা নিয়ে শিখবে। আপনি যদি ক্লাসের প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দদায়ক ও ইন্টারেক্টিভ করতে পারেন তবেই শিক্ষকতা উপভোগ্য হবে।
♦পার্থক্য তৈরী করা
শিক্ষকতা মানে শুধু পড়ানো না, একটা অনেক বড় দায়িত্ব। শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় কাজ হল ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসা এবং একটা পার্থক্য তৈরী করা। ছাত্র-ছাত্রীরা যেন আপনার ক্লাসে নিরাপদ এবং বিশেষ করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এই অনুভূতিটা আপনার ক্লাসে তৈরি করাটা খুব জরুরী। যাতে আপনার একটা ইতিবাচক প্রভাব তাদের মধ্যে থাকে কারন আপনি জানেন না ক্লাসে ঢোকার পূর্বে কিংবা ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পর তারা কি ধরনের বাস্তবতা বা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সময় পার করে। সুতরাং তারা যদি পরিবার থেকে যথাযথ সাপোর্ট নাও পায় তবুও অন্ততপক্ষে আপনি তাদের জীবনে একটা পার্থক্য তৈরি করতে পারবেন।
♦ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দিন
ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ক্লাসে ঢুকুন প্রতিদিন। আপনার সুন্দর হাসিটি ধরে রাখুন সারাদিন এবং ছড়িয়ে দিন ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। ক্লাসে ঢোকার পূর্বে আপনার সমস্ত সমস্যা, ব্যক্তিগত প্রতিকূলতা-কষ্ট দরজার ওপাশে রেখে আপনার সর্বোচ্চটুকু নিয়ে হাজির হন ক্লাসে, বজায় রাখুন এই মুখোশটি এবং আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের ভাবতে দিন আপনাকে একজন সুপার হিরো হিসেবে। সবসময় ইতিবাচক এবং পজেটিভ এনার্জি নিয়ে ক্লাসে থাকলে তা যেমন ছড়িয়ে পড়ে তেমনি নেতিবাচকটাও ছড়িয়ে পড়ে উল্টোভাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন আপনি কী করবেন।
♦আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের চিনুন
একজন সফল শিক্ষকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্ধে খুব ভাল করে জানেন এবং তাদের আগ্রহ, সবলতা-দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত। এই তথ্যগুলোর ভিত্তিতে তাদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেন। ক্লাসরুমের বাইরে আলাপচারিতায় শিক্ষার্থীকে সহজেই চেনা যায় বিভিন্নভাবে। আপনি আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের যত ভালোভাবে জানবেন, পড়ানোটা তত সহজ হবে।
♦নিজের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিন
শিক্ষক হিসেবে আপনি যখন নিজের সর্বোচ্চটুকু দিতে পারবেন তখনি আপনি আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে তাদের সর্বোচ্চটা প্রচেষ্টা প্রত্যাশা করতে পারবেন। তাই নিজের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দিন।
♦মুক্তমনা হোন
মুক্তমনা হওয়া এবং গঠনমূলক সমালোচনাকে পজিটিভভাবে নেওয়া একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কারন আপনি প্রতিনিয়ত আপনার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক, সহকর্মী এবং প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে সমালোচিত হন। কেউ-ই নিখুঁত নয়। সুতরাং সমালোচনাগুলো নিজের উন্নতির জন্য টিপস হিসেবে ব্যবহার করুন।
♦একটি আদর্শ মানদণ্ড নির্ধারণ করুন
শিক্ষক হিসেবে কাজের একটি আদর্শ মানদণ্ড নির্ধারণ করুন এবং তা শিক্ষার্থীদের সাথে শেয়ার করুন। যাতে তারা বুঝতে পারে আপনি তাদের কাছে কি রকম কাজ ও ফলাফল প্রতাশা করেন এবং তারা তা পূরনে নিজেদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
♦গোছালো হন
কাজগুলো প্লান করে, গুছিয়ে করুন। ক্লাসের লেসন প্লান তৈরি করুন। আপনি যদি গুছিয়ে এবং প্লান অনুযায়ী ক্লাস নেন তাহলে নিজেকে এবং শিক্ষার্থীদের অবস্থান বুজতে পারবেন এবং সেই অনুযায়ী করণীয় ঠিক করতে পারবেন।
♦নিজেকে প্রস্তুত করুন
পড়ানোর জন্য আপনাকে কোনকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হবে না। একজন দক্ষ ও ক্রিয়েটিভ শিক্ষক সবকিছু এবং সব আইডিয়া নিজে সৃষ্টি করেন না বরং বিভিন্ন জায়গা থেকে রিসোর্স সংগ্রহ করেন। তাই নিজেকে আপডেটেড ও সমৃদ্ধ করতে নিয়মিত বই, ইউটিউব, পিন্টারেস্ট, ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় রিসোর্স সংগ্রহ করুন ও প্রস্তুতি নিন।
♦পরিবর্তনকে গ্রহন করুন
জীবনে সবকিছু পরিকল্পনা করে হয় না, পরিস্থিতির কারনে এবং প্রয়োজনে আমাদের কাজে পরিবর্তন আনতে হয়। আপনি যদি পরিবর্তনকে গ্রহন করেন এবং নতুন নতুন বিষয় ও কৌশল আয়ত্ত করেন তবেই আপনার দক্ষতা সময়ের সাথে বাড়বে।
♦নিজেকে সময় দিন এবং চিন্তার প্রতিফলন করুন
একজন দক্ষ শিক্ষক নিজের ক্লাসে যা ঘটে তা প্রতিনিয়ত চিন্তা করে এবং প্রতিফলনের মাধ্যমে বুঝতে পারে কিভাবে আরো ভাল করা যায়, ব্যর্থ্যতা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। তাই দক্ষতা বাড়াতে নিজেকে সময় দিন প্রতিনিয়ত, ভাবুন কী ভাল ছিল, কী পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই আপনি দক্ষ শিক্ষক হয়ে উঠবেন। শুধু অন্যের ভুল ত্রুটি না ধরে মাঝে মাঝে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করুন। আত্ম সমালোচনা করুন। অন্যকে সম্মান দিন। যে প্রতিষ্ঠানে কর্মচারত রয়েছেন সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান কে সমালোচনা নয় সহযোগিতা করুন। মনে রাখবেন প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা প্রতিষ্ঠানকে যদি ভালো না বাসতে পারেন তবে শুধু কয়েকটি টাকার জন্য এ পেশাই আসা উচিত নয়।তার চেয়ে বরং ব্যবসা করুন অনেক টাকার মালিক হতে পারবেন ।
এই এগারটি টিপস মনে রাখলে এবং নিয়মিত চর্চা করলে শিক্ষকতা যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর গুরুত্বপূর্ণ পেশা; তা উপভোগ সম্ভব।তা না হলে৷ শুধু শুধু টাকা কামাই করার জন্য আপনাদের এই পেশায় না আসাই উত্তম ।
জাকির হোসেন মিলন
সাবেক শিক্ষার্থী,নৃবিজ্ঞান বিভাগ বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও
অধ্যক্ষ, ওয়ার্ল্ডপ্লাস রেজিডেনশল স্কুল এন্ড কলেজ, ঠাকুরগাঁও।
প্রকাশক ও সম্পাদক : জাকির হোসেন মিলন
Copyright © 2024 Ushar Alo bd. All rights reserved.